মুর্শিদাবাদ কেন যাবেন?
মুর্শিদাবাদের নামটি শুনলেই একটা ঐতিহাসিক গন্ধ লাগে গায়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিদ্রোহ বিপ্লবের সব দৃশ্য। বজ্রপাতের ভেতরে যেমন ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য খেলা করে, ইতিহাসও তেমনি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাক্ষী রাখে তার স্থাপত্য–ভাস্কর্য আর অধিগম্য অবশিষ্টাংশের অবয়বে। মলিনতার স্তরে ফুঁ দিয়ে ধুলো সরিয়ে দিলে বালুকণাও যে হীরকদ্যুতি বিচ্ছুরিত করে, হাজারদুয়ারি গেলে তা স্পষ্ট হয়। শিয়ালদা থেকে প্রতিদিন একাধিক এক্সপ্রেস ও প্যাসেঞ্জার ছাড়ে। পছন্দ মতো ট্রেনটি বেছে নিন আর পা রাখুন মুর্শিদাবাদে। হাজারদুয়ারি সফরের অনুভব ঘোড়ায় টানা টাঙায় সওয়ারি হওয়াতে অনেকাংশে লুকিয়ে থাকে; তবে বিকল্প টোটো গাড়ি। খুব ভোরে পৌঁছলে, স্টেশন থেকে মিলবে টাঙা।

ইতিহাসের পদধ্বনি শুনতে পাবেন ঘোড়ার খুরের শব্দে। শীতের শিশির, সকালের মিষ্টি রোদে স্বাগত জানাবে ইতিহাস। শুরুতেই প্যালেসে না ঢুকে বেড়িয়ে আসুন সংলগ্ন স্থানগুলি। প্রয়োজনে উঠুন গঙ্গাপাড়ের হোটেলে। কাটরা মসজিদের প্রবেশ পথ পেছন দিকে। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এই স্থাপত্যটির বিপর্যয় পরবর্তী রূপটি এখনও বেশ সুন্দর– ইতিহাসকে স্পর্শ করার মতোই। প্রশস্ত চত্বরে পদচারণা শতাব্দী প্রাচীন অনুভব এনে দেবে। অনতিদূরে আছে অসমাপ্ত ফৌতি মসজিদ। কাঠগোলা বাগানে ঢুকতেই হনুমানদের অভ্যর্থনা মিলতে পারে। জলমগ্ন সুড়ঙ্গপথ রেখে এগোলেই সুদৃশ্য হলুদরঙা কাঠগোলা প্রাসাদ, সামনে দিঘি। পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারতুল্য কল্পনা মনে আসতে পারে। দেখা মিলবে পরেশনাথ ও আদিনাথের মূর্তি। জৈন মন্দিরে আছে নান্দনিক কারুকার্যে খোদাইকৃত ছবি, জাফরির কাজ। মন্দির লাগোয়া এলাকায় একটি বিশাল পাতকুয়ো, নাটমঞ্চ এবং পরিত্যক্ত মহল আছে। অনতিদূরে হাজারদুয়ারি অনুকৃত নসিপুর রাজবাড়ি, কুখ্যাত দেবী সিংয়ের উত্তরপুরুষ কীর্তিচাঁদের বসতবাড়ি ছিল এটি।

সুবিশাল প্রাসাদের মন্দির চত্বরে আছে দশাবতার, মহাবীর মূর্তি, সঙ্গে পুতুল দ্বারা বর্ণিত বিষ্ণুপুরাণের কাহিনী। এরপর যাবেন নসিপুর আখড়া, দেওয়ালে দেখতে পাবেন নবাব–ইংরেজ যুদ্ধ চিত্রমালা। আখড়াতে সোনা–চাঁদির রথ, অস্টিন গাড়ি আর ঝাড়বাতির নিচে আখড়াটি যেন মূর্ত স্মৃতি–স্মারক। এখানে নিত্য পূজিত হন জগন্নাথ। জগৎ শেঠদের আস্তানা মহিমাপুরের কাছারি বাড়ি ও মন্দিরটির নবসংস্কৃত রূপ বেশ চমকপ্রদ। রোমহর্ষক দুটি ছোট সুড়ঙ্গকে প্রদর্শনশালা বানানো হয়েছে– নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র, মুদ্রা, বাসন, মসলিন ও সামরিক পোশাক দেখা যাবে। জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ ও সমাধিক্ষেত্রের অবস্থান মুখোমুখি।

প্রাসাদটি সুদৃশ্য। মিরজাফর ও তাঁর বংশধররা সমাহিত আছেন বেগম শাহখানমের পছন্দের এই বাগানে, যা এখন সমাধিক্ষেত্র। বিকেলের রোদ পড়লে ‘বুলবুলি নীরব নার্গিসবনে।।।’ মনে আসবেই। সমাহিত শবেরা সব ইতিহাস তলে।।। তবু তাঁরা নিশ্চুপ নীরবে কথা বলেন। কন্যা আজিমুন্নেসার সমাধি নবাব মুর্শিদকুলির মতোই সোপানতলে। যার অধিকাংশই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। অবশেষে হাজারদুয়ারিতে হাজির হওয়া। এখানে মিলবে একাধিক স্থাপত্যের দেখা। উল্টোদিকে আছে বাংলার বৃহত্তম ইমামবাড়া। মাঝখানে আছে বিশাল এক কামান– বাচ্চাওয়ালি তোপ, যার শব্দে নাকি ঘটে যেত গর্ভপাত।

আছে ঘড়িস্তম্ভ, সিরাজের মদিনা। ইতালির শৈলীতে নির্মিত হাজারদুয়ারির সম্মুখে আছে কোম্পানির স্মারক দুটি সিংহ। ভিতরের প্রদর্শনশালায় আছে পলাশির যুদ্ধে মিরমদন ঘাতী কামান, হরেক রকম অস্ত্রপাতি, শিরস্ত্রাণ, ঢাল, বল্লম, মমি করা কুমির, পাখি, জাদু আয়না, রুপোর সিংহাসন, বিলিয়ার্ড বোর্ড, রানী ভিক্টোরিয়া প্রদত্ত ঝাড়বাতি, ভাস্কর্য, তৈলচিত্র, আইন–ই–আকবরির পাণ্ডুলিপি, হস্তলিখিত কোরান– এমন অজস্র জিনিস। এছাড়াও ঘুরে দেখবেন সাত গম্বুজের মুকুট পরা সুউচ্চ চক মসজিদ, সিরাজের সমাধি খোসবাগ, ঘসেটি বেগমের মতিঝিল, জাহানকোষা কামান, ওয়াসেফ মঞ্জিল, কিরীটেশ্বরী মন্দির, ডাচ আর্মেনীয় সমাধি ও গির্জা, টেরাকোটা সজ্জিত খেরুড় মসজিদ, কাশিমবাজার রাজবাড়ি। এখানকার স্থাপত্যগুলি হিন্দু ও মুসলিম শৈলীর সংমিশ্রণ আপনাকে সম্প্রীতির পাঠ দিতে পারে। এবছরের ভ্রমণসূচিতে মুর্শিদাবাদকে রাখলে মোটেই ভুল হবে না আপনার।

Comments
Post a Comment